খেলাপি ঋণের লাগামছাড়া উত্থান, উদ্বেগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আইএমএফ

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের লাগামহীন উত্থান এখন অর্থনীতির অন্যতম প্রধান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানামুখী পদক্ষেপ, সরকারি প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও ঋণখেলাপির এই ভয়াবহ প্রবণতা কমছে না, বরং দিন দিন আরও বেড়েই চলেছে।

সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮.১৬ শতাংশ। কিন্তু মাত্র এক বছরের ব্যবধানে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ২০ শতাংশ! অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা, যা আগের খেলাপির চেয়েও বেশি।

এই ঊর্ধ্বগতি শুধু ব্যাংকিং খাতেই নয়, নন-ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন (NBFI) খাতেও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ২০২২ সালের শেষে এসব প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ ছিল ১৭ হাজার কোটি টাকা। এখন তা দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ৩৬ শতাংশ।

আইএমএফ-এর চাপ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রোডম্যাপ

২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির সময় সংস্থাটি খেলাপি ঋণ কমানোকে একটি শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৫ শতাংশের মধ্যে রাখতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সে সময় একটি রোডম্যাপ প্রকাশ করে, যেখানে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব পদক্ষেপের কোনো কার্যকর ফল দেখা যায়নি। বরং তথ্য গোপন করেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি। আর রাজনৈতিক পালাবদলের পর ব্যাংক খাতে লুকানো দুর্নীতির চিত্র একে একে প্রকাশ হতে থাকে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পূর্ববর্তী সরকার আমলে ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন লুটপাট, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ অনুমোদন এবং বিদেশে অর্থপাচারই এই পরিস্থিতির মূল কারণ। এসব ‘ভুতুড়ে ঋণ’-এর অধিকাংশেরই কোনো জামানত নেই, কিংবা থাকলেও তা আদায়ে জটিলতা রয়েছে।

আইএমএফ-এর সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক, বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব

খেলাপি ঋণ নিয়ে আইএমএফ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে রোববার ও সোমবার একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, এবং আজ মঙ্গলবারও বৈঠক রয়েছে। বৈঠকগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণ কমাতে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরছে।

এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা কার্যকরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা এপ্রিল থেকে বাস্তবায়িত হয়েছে। এখন কোনো ঋণ তিন মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলেই তা খেলাপি বিবেচিত হবে, যেখানে আগে ছিল ছয় মাস। এই পরিবর্তনে খেলাপি ঋণ আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই উদ্যোক্তারা এর বাস্তবায়ন আরও পিছিয়ে দেওয়ার জন্য দাবি জানিয়েছে, যা আইএমএফকেও জানানো হবে।

জামানত বিক্রির চেষ্টা ও আইনি কাঠামোর দুর্বলতা

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ আদায়ে জামানত বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। সোনালী, ইসলামী, জনতা, ইউসিবি এবং ন্যাশনাল ব্যাংক ইতিমধ্যেই নিলামে তোলার মাধ্যমে কিছু অর্থ আদায় করতে পেরেছে। তবে এতে পূর্ণ ঋণ আদায় সম্ভব হচ্ছে না, বরং সামান্য অর্থ ফেরত আসছে।

এই বাধাগুলো দূর করতে নতুন আইন প্রণয়ন এবং বিদ্যমান আইনে সংশোধন আনতে যাচ্ছে সরকার। বিশেষ করে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও চাওয়া হচ্ছে—বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর কাছে।

আশঙ্কা আরও গভীর: বাড়তে পারে সুদ ও গ্যারান্টি ফি

আইএমএফ আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, খেলাপি ঋণের এই ঊর্ধ্বগতি চলতে থাকলে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হবে। আন্তর্জাতিক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বাড়তি সুদের হার, লেটার অব ক্রেডিট (LC) ইস্যুর সময় গ্যারান্টি ফি বাড়ানো ইত্যাদি শর্ত জুড়ে দেওয়া হতে পারে।

অর্থাৎ খেলাপি ঋণ শুধু অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকেই নয়, দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্ক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকেও সরাসরি প্রভাবিত করতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী করতে হলে খেলাপি ঋণের লাগাম এখনই টানতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের গৃহীত উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন, নজরদারি, এবং আইনগত প্রক্রিয়ার গতি—সব কিছুতেই গতি আনতে হবে। তা না হলে, শুধু পরিসংখ্যানেই নয়, বাস্তব জীবনেও এই ঋণ পাহাড় হয়ে দাঁড়াবে দেশের অর্থনীতির সামনে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের সর্বশেষ