গুলিবিদ্ধ সেই দিনমজুরের পাশে দাঁড়ালেন ইউএনও, হাসপাতালে ভর্তি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গর্ভবর্তী স্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছিলেন দিনাজপুরে হাসপাতালে। সে সময় পুলিশের গুলিতে আহত হন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার ২৮ বছর বয়সী দিনমজুর আব্দুর রশিদ। দিনমজুর হওয়ায় সাধ্য নেই চিকিৎসার। স্থানীয়দের সহায়তায় প্রাথমিকভাবে চিকিৎসায় বেঁচে ফিরলেও থমকে গেছে চিকিৎসা। স্বামীর চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাতে স্ত্রী বাধ্য হয়েই বিক্রি করে দেন তিন দিনের কোলের নবজাতক শিশুকে। সে টাকায় চলে চিকিৎসা। কিন্তু সেই টাকাও শেষ হয়ে যায়।  একদিকে অর্থের অভাব, আরেকদিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব (জন্মসনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র) না থাকায় মিলছিল না সরকারি কিংবা বেসরকারি সংস্থার চিকিৎসার সহায়তা। ঘটনাটি জানার পর যথাযথ দাপ্তরিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নাগরিকত্ব প্রদানপূর্বক চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছেন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফজলে রাব্বী।

রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) রাতে আহত আব্দুর রশিদকে নিজেই তেঁতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে গিয়ে ভর্তি করান তিনি। আহতের শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে কর্তব্যরত চিকিৎসকের সাথে পরামর্শে ঔষধপত্রসহ বিভিন্ন মেডিকেল টেস্টেট ব্যবস্থা করেন। টেস্ট রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনে আরও উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহ সকল ব্যয়ভার নিজেই বহন করবেন বলে ঘোষণা দেন ইউএনও।

জানা যায়, গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত দিনমজুর আব্দুর রশিদের বাড়ি তেঁতুলিয়ার ভজনপুরের মালিগছ গ্রামে। তিনি এই গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে। প্রায় ১০ বছর আগে মারা যান রশিদের মা রশিদা বেগম। পরে বাবা আবার বিয়ে করেন। পরিবারে বিভিন্ন বিষয়ে বনিবনা না হওয়ায় এক সময় ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান আব্দুর রশিদ। পরবর্তীতে দিনাজপুরের রাজবাড়ী এলাকায় গিয়ে গত কয়েক বছর ধরে ভাড়া বাড়িতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে ট্রাক্টর শ্রমিক হিসেবে জীবনযাপন করছিলেন।

গত ৪ আগস্ট দিনাজপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছিলেন আব্দুর রশিদ। তার বক্তব্য অনুযায়ী- হাসপাতালের গেটে পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজনের সহায়তায় চিকিৎসা করায় কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে যান। অর্থাভাব ও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর বাচ্চা প্রসবের সময় যখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে, ঠিক তখনই ধীরে ধীরে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে আব্দুর রশিদের। ৮ আগস্ট দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলে পর দিন তার অপারেশন হয়। অপরদিকে ৯ আগস্ট রাজবাড়ী এলাকার বাড়িতে আব্দুস রশিদের স্ত্রী রোকেয়া বেগম কন্যা সন্তানের জন্ম দেন।

সন্তান জন্ম দিলেও আনন্দ ছিলো না মনে। স্বামীর বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বা বৈধ পরিচয় সম্পর্কিত কোনো ধরনের কাগজপত্র না থাকায় একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায় তার চিকিৎসা। এমন জটিল এবং মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে দিনমজুরের স্ত্রী স্বামীর জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়েই রংপুরের এক দম্পতির কাছে ২৫ হাজার টাকায় শিশুকে বিক্রি করে দেন। সেই টাকায় চিকিৎসা শুরু হলেও বৈধ পরিচয়হীনতার  জটিলায় বন্ধ হয়ে যায় তার চিকিৎসা। ঘটনাটি জানাজানি হলে দ্রুত প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিক্রি করে দেওয়া সন্তান ফেরত পান আব্দুর রশিদের স্ত্রী।

এদিকে দিনমজুর আব্দুর রশিদের  জন্মসনদ বা নাগরিকত্ব সনদ না থাকার কারণে মিলছিল না কোন সরকারি-বেসরকারি আর্থিক সহায়তা। বিষয়টি জানার পর জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার লক্ষ্যে তাৎক্ষণিকভাবে জটিলতা নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন ইউএনও। দিনমজুর আব্দুর রশিদের তথ্য পাওয়া মাত্রই শুরু হয় দাপ্তরিক কার্যক্রম। আব্দুর রশিদের পরিচয় নিশ্চিত করতে ভজনপুর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে উপস্থিত হন ইউএনও ফজলে রাব্বি। সেখানে রশিদের ভাই আব্দুর রহমানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী একটি দল মালিগছ এলাকার নজরুল ইসলামের বাড়িতে।

খবর পাওয়া মাত্রই আব্দুর রহমানের বাবা নজরুল ইসলাম, কয়েকজন নিকটাত্মীয়সহ উপস্থিত হন সেখানে। সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্য, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ স্থানীয়দের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে আব্দুর রশিদের পরিচয় নিশ্চিত হন ইউএনও। ওই সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ফজলে রাব্বি, মিসবাহ উল্লাহ, হযরত আলী, মোকাদ্দেসুর রহমানসহ কয়েকজনের সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় এবং আব্দুর রশিদের জটিলতা নিরসনে ইউএনওকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করতে দেখা যায়।

হাসপাতালে চিকিৎসা হওয়ার পর আহত আব্দুর রশিদ বলেন, ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে পারিবারিক ঝামেলা ও বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের কারণে পরিচয়পত্র বা জন্মসনদ নিতে পারিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চলাকালে স্ত্রীকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হই। আমার চিকিৎসার জন্য আমার স্ত্রী আমার কন্যা শিশুকেও বিক্রি করে দেয়। কিন্তু দেশের ভোটার বা নাগরিক না হওয়ায় কোনো সহযোগিতা পাচ্ছিলাম না।  আমার শরীরে এখনো চারটা গুলি রয়েছে। পরিচয় না থাকায় সবাই আমার চিকিৎসা করতে ভয় পায়। বিষয়টি ফোনে ইউএনও স্যারকে জানালে, তিনি নিজে ইউনিয়ন পরিষদে এসে আমার সব কথা শোনেন। পরে তিনি আমার পরিচয় দেওয়ার জন্য সকল ব্যবস্থা নিজে বসে থেকে করেন এবং আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করান। মধ্যরাত পর্যন্ত তিনি আমার পাশেই ছিলেন।

আব্দুর রশিদ বলেন, এই বিপদে স্যার সাহায্য করেছেন। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। সেই সঙ্গে নতুন বাংলাদেশের নাগরিক হতে পেরে আমি অনেক আনন্দিত। যদিও দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমি এখনো দেখতে পারিনি, হাসপাতালের চার দেয়ালের কারণে। আমি চাই দেশটা ভালো চলুক। দেশের মানুষ শান্তিতে থাকুক।

আহত আব্দুর রশিদের বড় ভাই আব্দুর রহমান বলেন, আমরা গরিব মানুষ। আমার ভাইয়ের চিকিৎসা করাতে পারছি না। বাধ্য হয়ে চিকিৎসা করার জন্য তাদের সন্তানকে বিক্রিও করে দিয়েছিলেন তার স্ত্রী । সেই টাকা দিয়ে চিকিৎসাও করানো হয়েছে কিন্তু এখন আমরা নিরুপায়। আমার ভাই দেশের নাগরিক না হওয়া সে সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত ছিল। অবশেষে আমাদের ইউএনও স্যার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। প্রয়োজনে আরও উন্নত চিকিৎসা করাবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন ইউএনও স্যার।

প্রতিবেশী আব্দুল কাদের বলেন, রশিদ ছোটবেলায় মাকে হারানোর পর সৎ মায়ের কাছেই বড় হয় অনেক কষ্টে। কয়েক বছর আগে বাড়ি থেকে ঝগড়া করে চলে যায়, আর ফেরেনি। আমরা ফেসবুকে জানতে পারি রশিদ পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছে, চিকিৎসার জন্য তার সন্তানকে বিক্রি করেছে। পরে বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে জানালে ইউএনও স্যার নিজে এসে সব ব্যবস্থা করেছেন, হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন। আমাদের বলেছেন দুঃশ্চিন্তা না করতে।

আব্দুর রশিদের বাবা নজরুল ইসলাম বলেন, আমার ছেলে পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছে। টাকার অভাবে তার চিকিৎসা বন্ধ, তার নাগরিক সনদ হওয়ায় চিকিৎসকরা চিকিৎসা করেনি। আমি বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে জানাই। পরে ইউএনও আমার ছেলেকে জন্ম সনদ তৈরি করে দেন এবং তার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন। আমি ইউএনও মহোদয়কে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ তার ভাল করুক।

তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফজলে রাব্বি বলেন, গুলিবিদ্ধ ও গুরুতর আহত আব্দুর রশিদের পরিচয়হীনতা, স্বামীর চিকিৎসার জন্য তার স্ত্রীর সন্তান বিক্রির মত মর্মান্তিক ঘটনা জানার পর জেলা প্রশাসক মো. বাসেত আলী স্যারের নির্দেশে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ, স্থানীয় ব্যক্তিবর্গসহ সকলের সহযোগিতায় কাজটি সম্ভব হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সরেজমিনে সকল তথ্য সংগ্রহ ও অন্যান্য সকল বিষয়ে বিশেষ সহায়তা করেছে কয়েকজন তরুণ সমন্বয়ক। সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই তার নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়েছে। তার শরীরে এখনো গুলি রয়েছে। এছাড়াও পূর্বের অপারেশন থেকে তিনি এখনো আশঙ্কামুক্ত নন। শারীরিকভাবে সুস্থ্য না হওয়া পর্যন্ত তিনি উপজেলা প্রশাসনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে  থাকবেন। প্রয়োজন হলে ঊর্ধ্বতন নির্দেশনা অনুযায়ী আরও উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। সবাই তার জন্য দোয়া করবেন।

 

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের সর্বশেষ