‘পাকিস্তান সৃষ্টির পর ইমরান খানের মতো জনপ্রিয় নেতা তৈরি হয়নি’

পাকিস্তানের চলমান ঘটনাপ্রবাহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিশেষ বার্তা দিচ্ছে উল্লেখ করে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, জনমতের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বেশিদিন টেকা যায় না, পাকিস্তানে বারবার তার প্রমাণ মিলছে। তিনি মনে করেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর অবস্থান, ভুয়া মামলা, জেল দেওয়ার মতো ঘটনা ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে।

পাকিস্তানের মানুষ কি নিজেরা নিজেদের শাসন করতে পারবে না? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আপনি যদি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করেন, তাহলে আমরা পাকিস্তানের চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছি। পাকিস্তানে তো ভোট চুরি হয়নি। রেজাল্ট চুরি হয়েছে। বাংলাদেশে, ভোট, ব্যালট, রেজাল্ট সবই চুরি হয়। মানুষ ভোট দিতে না পারলে ইমরান খানের দল পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা এভাবে বিজয়ী হতে পারতেন না।’

‘পাকিস্তান আমাদের সঙ্গে অন্যায় করেছে। তাই বলে তুলনা করে আপনি বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারবেন না। পাকিস্তানের আদালত ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রীকে সাজা দেওয়ার মতো দৃষ্টান্ত রাখে। মানুষ সেখানকার আদালতে গিয়ে রিলিফ পায়। নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে এত খারাপ ধারণা রাখে না। নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা থাকলে এত মানুষ ভোট দিতে যেত না। পাকিস্তানের সার্বিক বিষয়ে সমালোচনা করতে গেলে নিজেদের দিকে আগে তাকানো দরকার।’

চলমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানে এখনকার ঘটনাপ্রবাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ ভোট দিতে পেরেছে এটি একটি আশার কথা। ৪০টি আসনের রেজাল্ট জালিয়াতি হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। অনেকেই হয়তো ফেরত পাবে। জামায়াতের এক প্রার্থী তার রেজাল্ট ফেরত দিয়েছেন। এটি নজিরবিহীন ঘটনা। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশে এটি কল্পনা করা যায়! আপনি তুলনা করে সমালোচনা না করলে ছোট মনের পরিচয় দেবেন। আপনি একবার ভাবুন তো বাংলাদেশের মতো জায়গায় কেউ ইমরান খান হয়ে উঠতে পারতো? পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইমরান খান গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।’

‘পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী সব সময় হস্তক্ষেপ করে এসেছে। কিন্তু এই নির্বাচনের পর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। এক জরিপে দেখা গেছে, সেনাবাহিনীর ৮০ শতাংশ সদস্য ভোট দিয়েছে ইমরান খানকে। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ার কেন্দ্রগুলো থেকে পিটিআই এমন তথ্য প্রকাশ করেছে। নইলে তারা এতগুলো ভোট পেত না। রেজাল্ট জালিয়াতি না করলে তো পিটিআই এককভাবে ক্ষমতায় যেত।’

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমেরিকা যুক্ত। ভূ-রাজনীতির কারণে আমেরিকা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখে। আমি মনে করি, পাকিস্তানের সব ক্যু-তে আমেরিকার প্রচ্ছন্ন প্রভাব রয়েছে। আমেরিকা ইমরান খান সরকারকে চাইছে না।

কিন্তু ইমরান খানের সঙ্গে প্রধানত দ্বন্দ্ব তো সেনাবাহিনীরই? জবাবে বলেন, ‘সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের প্রথমত দ্বন্দ্ব আএসআই প্রধানকে নিয়ে। এরপর সে চেষ্টা করেছে সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ খর্ব করা। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমেরিকা যুক্ত। ভূ-রাজনীতির কারণে আমেরিকা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখে। আমি মনে করি, পাকিস্তানের সব ক্যু-তে আমেরিকার প্রচ্ছন্ন প্রভাব রয়েছে। আমেরিকা ইমরান খান সরকারকে চাইছে না।’

এখন তো ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ভালো। ভারত-আমেরিকা দক্ষিণ এশিয়ায় নিরাপত্তার প্রশ্নে একাট্টা। বিশ্লেষণে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমেরিকার এখন সম্পর্ক ভালো এটি বাস্তব। কিন্তু ভারত এবং পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ভালো ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তান ইস্যুতে আমেরিকা পাকিস্তানকে গুরুত্ব দেয়। পাকিস্তানের মাধ্যমে তালেবান, মুজাহিদ তৈরি হয়েছে। পাকিস্তান রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। আমেরিকা এসবে যুক্ত। ভারত তো এসব করেনি।’

ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক চীন বিরোধিতার কারণে। আমেরিকা জানে পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে দেশটির সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানের মানুষ এখন সেনাবাহিনীর অবস্থান নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করছে। সেনাবাহিনীর বড় অংশও পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছে। ইমরানের সমর্থকদের ভোটের ফলাফল তা প্রমাণ করে। ঠিক এ কারণেই নওয়াজ শরিফ লজ্জা পেয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি। বিলওয়ালও কোনো পদ চাননি। কারণ তিনি জানেন পাকিস্তানের যে অবস্থা, সেখানে প্রধানমন্ত্রী হলে সামাল দিতে পারবেন না।’

তাহলে শাহবাজ শরিফের জন্য কি অপেক্ষা করছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শাহবাজ শরিফের আসলে বিশেষ কিছু করার নেই। তবে তিনি মনে করেন পাঞ্জাব তার সঙ্গে আছে। পাঞ্জাব ঠিক থাকলে বাকি সব ঠিক থাকবে।
কিন্তু শাহবাজ খুব সহজে চালাতে পারবে, আমার তা মনে হয় না। কে পাকিস্তানকে টাকা দেবে? এক সময় দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের অবস্থান সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল। সেই পাকিস্তানের অর্থনীতি টালমাটাল। ৫০ বছর আগে পাকিস্তানে ১০ টাকার মান এখন এক হাজার টাকা। যদিও আমাদের বাংলাদেশের অবস্থা আরও খারাপ। তবে শাহবাজ সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ বাড়বে। সংসদে পিটিআই সমর্থকরা শক্তিশালী বিরোধী শক্তি গঠন করবে।’

ইমরান খানের ভাগ্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইমরান খান উচ্চ আদালতে জামিন পেয়ে যাবেন। তার বিরুদ্ধে বেশির ভাগই ভুয়া মামলা। এগুলো কোনো মামলাই নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মামলার মতোই।’

 

‘ইমরান খানের বিরুদ্ধে যেসব মামলা করা হয়েছে এবং যেভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে তাতে তার জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়েছে। ইমরান খানকে সরিয়ে দেওয়ার পর আমি পাকিস্তানে ঘুরতে গিয়েছিলাম। ইমরান খানের পক্ষে মিছিল, স্লোগান দেখে মনে হয়েছে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর ইমরানের মতো জনপ্রিয় নেতা তৈরি হয়নি। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে। বিশেষ করে তরুণরা। নিজের চোখে দেখে আসছি। ইমরান খান পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলে হয়তো ব্যর্থ হতেন। কিন্তু তাকে সরিয়ে আরও জনপ্রিয় করে তুলছেন। জেল-জুলুমে জনপ্রিয়তা বাড়ে।’ বলেন, সাখাওয়াত হোসেন।

পাকিস্তানের রাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও বিশেষ বার্তা উল্লেখ করে বলেন, ‘পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে আছে। মিয়ানমার, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ছে। পাকিস্তানে বেশ ক’জন এডিসি পদত্যাগ করেছেন। আমাদের এখানে সম্ভব? জনমতের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বেশিদিন টেকা যায় না। পাকিস্তানে বারবার তাই ঘটছে। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এই বার্তা গুরুত্ব পাচ্ছে।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের সর্বশেষ