রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

৭২ % ব্যবসায়ী মনে করেন কর কর্মকর্তারা দুর্নীতিগ্রস্ত: সিপিডি জরিপ

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা দেশের কর ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন। এবার গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) পরিচালিত এক জরিপে উঠে এসেছে আরও স্পষ্ট চিত্র। ওই জরিপ অনুযায়ী, দেশের বিপুল সংখ্যক ব্যবসায়ী মনে করেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীন কর কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি বিদ্যমান।

মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে আয়োজিত এক সংলাপ অনুষ্ঠানে এ জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল— “করপোরেট ট্যাক্স ও ভ্যাট সংস্কার: এনবিআরের জন্য ন্যায়সংগত দৃষ্টিভঙ্গি”। সেখানে উপস্থিত ছিলেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, রাজস্ব বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা ও খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা।

ডিসেম্বর ২০২৪-এ পরিচালিত এই জরিপে মোট ১২৩টি কোম্পানির প্রতিনিধির কাছ থেকে মতামত নেওয়া হয়। ফলাফলে দেখা যায়—

  • ৭২ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন কর কর্মকর্তারা ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত।

  • ৮২ শতাংশ ব্যবসায়ী বলছেন, বাংলাদেশের বর্তমান কর ব্যবস্থা অসঙ্গতিপূর্ণ ও জটিল।

  • প্রতি পাঁচজন ব্যবসায়ীর মধ্যে চারজন কর কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতার অভাব উল্লেখ করেছেন।

জরিপে আরও উঠে এসেছে, করদাতারা প্রায়ই কর দপ্তরে গিয়ে অপ্রত্যাশিত ঝামেলার মুখে পড়েন। অনেকেই মনে করেন, রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে সঠিক নীতি না থাকায় কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ক্ষমতার অপব্যবহার হয় এবং সেটিই দুর্নীতিকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ব্যবসায়ীরা জানান, কর প্রদানের প্রক্রিয়া এখনও জটিল ও সময়সাপেক্ষ। অনেক ক্ষেত্রে কর কর্মকর্তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়, যা দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করে। তাদের অভিযোগ, অনলাইন বা অটোমেটেড সিস্টেম চালু থাকলেও বাস্তবে তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। ফলে কর্মকর্তা-কেন্দ্রিক কর আদায় প্রক্রিয়া এখনো বহাল রয়েছে।

একজন ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘‘আমরা কর দিতে চাই, কিন্তু প্রক্রিয়ায় যে অস্বচ্ছতা রয়েছে সেটি ভয়ঙ্কর। কর কর্মকর্তাদের অনেকেই করদাতাদের সেবার পরিবর্তে ব্যক্তিগত স্বার্থকেই প্রাধান্য দেন।’’

সিপিডির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনবিআরের অধীনে থাকা কর কর্মকর্তারা দেশের রাজস্ব আহরণের মূল চালিকাশক্তি হলেও তাদের অনেকের আচরণ ব্যবসায়ীদের আস্থা নষ্ট করছে। কর আদায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকলে সরকারের রাজস্ব লক্ষ্য অর্জনও দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিতে পড়বে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, করদাতাদের মধ্যে অসন্তোষ থাকলে তারা কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বাড়াতে পারে। আর এতে করে রাজস্ব ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান স্বীকার করেন যে কর ব্যবস্থায় নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘ব্যবসায়ীরা যেন কোনোভাবেই মনে না করেন, তাদের হয়রানি করার জন্য ভ্যাট বা কর আদায়ের নামে আমরা পদক্ষেপ নেই।’’

তিনি আরও জানান, ‘‘আমরা অটোমেশনের দিকে যাচ্ছি। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু হলে কর কর্মকর্তাদের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় যোগাযোগ কমবে, ফলে দুর্নীতির সুযোগও হ্রাস পাবে।’’

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এই জরিপের ফলাফল নতুন কিছু নয়, বরং দীর্ঘদিনের সমস্যা আরও স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে। তাদের মতে, কর প্রশাসনে দুর্নীতি ও অনিয়ম দমন না করলে টেকসই রাজস্ব আহরণ সম্ভব হবে না।

একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘‘বাংলাদেশ এখন বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ যদি দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে অর্থনীতি বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে।’’

সিপিডির পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়, এনবিআরের ভেতর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন তদারকি ইউনিট গঠন করা দরকার। একই সঙ্গে কর কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ করার ওপর জোর দেওয়া হয়।

ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, করনীতিকে সরল করতে হবে, করছাড় নীতিতে শৃঙ্খলা আনতে হবে এবং সবচেয়ে বড় বিষয় হলো— কর কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে।

এই জরিপ কার্যত আবারও প্রমাণ করল, ব্যবসায়ী সমাজ কর প্রশাসনের ওপর আস্থা হারাচ্ছে। দুর্নীতি, অসঙ্গতি ও জবাবদিহির অভাব দূর না হলে রাজস্ব খাতের লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব হয়ে পড়বে। এখন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো— সংস্কারের ঘোষণা বাস্তবায়ন এবং ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা।

শেয়ার করুন