বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: যে সত্য উন্মোচন আজও প্রয়োজন

আগস্ট হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কুশীলব কারা, তা এখন অনেকটাই প্রকাশ্য। তবে এখনও অজানা রয়ে গেছে অনেক প্রশ্নের উত্তর। দেশের নাগরিক সমাজ, মুক্তিযোদ্ধা, অধিকারকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্য কুশীলবদের শনাক্ত করতে করণীয় বলতে গিয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের দাবি, কিছু সত্য উন্মোচিত হওয়া দরকার। গবেষকরা বলছেন, এই দাবির পেছনে যেমন যৌক্তিক আবেগ আছে, তেমনি রয়েছে জরুরি কিছু প্রশ্নের না পাওয়া উত্তর খোঁজার দায়। বিচার শেষ হওয়ার পরে কেন এই কথা মনে হচ্ছে—প্রশ্নে তারা বলছেন, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড সাধারণ কোনও হত্যাকাণ্ড ছিল না। ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে জন্মের পরেই মেরে ফেলার দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। সে কারণে ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন হলেও এ ঘটনার নেপথ্যের ষড়যন্ত্র উন্মোচনের বিকল্প নেই।

চলতি বছর ২৩ জানুয়ারি বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি রুল জারি করেন। ওই রুলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে এক স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর রিটের পর সুবীর নন্দী দাস জানিয়েছিলেন, রিট আবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তদন্ত কমিশন গঠনের নজির যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ১৯৮২ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের নিয়ে গঠিত বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ বিষয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র এবং তারপরের পদক্ষেপগুলো সম্পূর্ণ পর্যালোচনা ও নিরীক্ষার লক্ষ্যে একটি স্বাধীন জাতীয় কমিশন গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়।

আদালতের বাইরে রাজনৈতিক অঙ্গনেও এই কমিশনের দাবি বারবার উঠেছে। গত বছর আগস্টে শোকের মাসে বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্য নায়কদের খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিশন গঠন সময়ের দাবি উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সুবিধাভোগী কারা ছিল? কারা ষড়যন্ত্র করেছে? জিয়া, মোশতাকের কাজ— সেটা পরিষ্কার করে দেয়। সেই ষড়যন্ত্র এখনও আছে। কেননা, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করেছে।’

যে প্রশ্ন বারবার সামনে আসে তার অফিসিয়াল উত্তর খুঁজে বের করতে হবে বলে গবেষকরা বলছেন, ক্ষমতার লোভে যে জিয়াউর রহমান ষড়যন্ত্র রচনা করলো, তার শুরুটা কীভাবে হয়েছিল? অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে পুরো হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে জিয়াউর রহমান কাদের হস্তক্ষেপে টিকে গেলো। বঙ্গবন্ধু যাদের ওপর আস্থা রেখেছিলেন, তারা ঠিক কোন আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রক্ষা করতে গাদ্দারে পরিণত হলো?

তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে কোন প্রশ্নগুলোর উত্তর উন্মোচন করা জরুরি জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘১৯৭৫ সালের পর থেকে লম্বা সময় যারা দেশ শাসন করেছে, তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার অনেক তথ্য গায়েব করে দিয়েছে। দেশকে আবারও পাকিস্তান রাষ্ট্রে পরিণত করতে সব পরিকল্পনা সম্পাদন করেছিল। হত্যাকাণ্ডের পরের দিন থেকে খন্দকার মোশতাকের দেওয়া নির্দেশগুলো লক্ষ করলেই বুঝা যাবে। কোন নির্দেশনার পেছনে কী ছিল, তার ব্যাখ্যা বের হওয়া দরকার। যে নথি নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়।’

তদন্ত কমিশনের কথা উঠলেই এক শ্রেণি বলে বিচার হয়ে যাওয়া ঘটনায় আবার তদন্ত কমিশন কীসের। সে বিষয়ে জানতে চাইলে এই বিচারপতি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে বলে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি কি? বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যের ঘটনা স্পষ্ট হতে হলে, কোথাও যেন খটকা না থাকে, সেটা বের করে আনতে অবশ্যই তদন্ত কমিশন দরকার। এমন একটা তদন্ত কমিশন—যারা যেকোনও কঠিন মুহূর্তে পিছপা হবেন না।’

মনে রাখা দরকার, এই তদন্ত কমিশন কাউকে শাস্তি দেওয়ার জন্য না। যে প্রশ্নগুলো বারবার উত্থাপিত হয় তার উত্তর জানার জন্য এই কমিশন দরকার। প্রশ্নগুলো কী, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাক্ষী সবুতে যা কিছু বেরিয়ে এসেছে, তার বাইরেও অনেক মানুষ অনেক সংস্থার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদত ছিল হত্যাকাণ্ডে। সেগুলো কী? হত্যাকাণ্ডের দিন কিছু বিপথগামী সেনা সদস্য বেরিয়ে এসেছিল, কিন্তু সেদিন যে ট্যাংক নিয়ে বের হয়েছিল সেটাতে গোলা ছিল না বলে পরবর্তী সময়ে জানা গেলো। এই যে পরিকল্পনা, গোলা ছাড়াও এত বড় কাণ্ড ঘটানো যাবে, সেটা কে জানতো। জনগণের কাছে সেই খবর গেলো না কেন?’

ভুলে গেলে চলবে না, ১৫ আগস্ট তারিখটি হুট করে আসেনি। এবং এরপরে লম্বা সময় তারা দেশ শাসন করেছে। এই পুরো সময়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে একটি গ্রুপ। কিন্তু পেছনে দেশে-বিদেশে কারা কাজ করেছে, তা উন্মোচিত হওয়া দরকার, তাদের পেছনে কারা ছিল। আমরা জানতে পাই, জেল হত্যার পর খুনিদের প্লেনে করে ব্যাংকক পার করে দেওয়া হলো। সেই ব্যবস্থা, ব্যাংককে বিমানবন্দরে যোগাযোগ স্থাপন হলো কীভাবে, সেসব প্রশ্নের জবাব দরকার বলে উল্লেখ করেন বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক।

//এমটিকে

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের সর্বশেষ