নিজস্ব প্রতিবেদক :
২০০৬ সালের এই দিন ২৮ অক্টোবর। দেশের রাজনীতিতে এক ভয়াল ও কলঙ্কিত দিন হিসেবে ইতিহাসে রয়ে গেছে। রাজধানীর পল্টন ময়দান এবং আশপাশের এলাকা সেদিন পরিণত হয়েছিল রণক্ষেত্রে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সমাবেশ ও জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত সমাবেশ ঘিরে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষে প্রাণ হারান অন্তত ১২ জন, আহত হন কয়েকশ রাজনৈতিক কর্মী। টেলিভিশন পর্দায় সেদিন যে দৃশ্য দেখা গিয়েছিল লগি-বৈঠা হাতে মানুষ পেটাচ্ছে, মৃতদেহের ওপর নৃত্য চলছে তা সারা দেশকেই স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
উত্তপ্ত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
২০০৬ সালের শেষ দিকে চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষের সময় ঘনিয়ে আসে। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতি কে.এম. হাসানের নাম ঘোষণা হলে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোট তা প্রত্যাখ্যান করে। তারা দাবি তোলে, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন হবে না। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট নিজেদের অবস্থান থেকে সরতে রাজি হয়নি। রাজনৈতিক অচলাবস্থা চরমে পৌঁছালে উভয় পক্ষ একই দিনে সমাবেশের ডাক দেয়—জামায়াতে ইসলামী পল্টনে, আর ১৪ দল বাংলামটরে।
সংঘর্ষের সূচনা
২৮ অক্টোবর সকালে দুই সমাবেশেই হাজার হাজার নেতা-কর্মীর সমাগম ঘটে। এক পর্যায়ে বাংলামটর থেকে মিছিল নিয়ে ১৪ দলের কর্মীরা পল্টনের দিকে অগ্রসর হলে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। চোখের পলকে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। হাতে লগি-বৈঠা, বাঁশ, লাঠি, ইট-পাটকেল নিয়ে কর্মীরা একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্থানীয়রা জানান, পুলিশ প্রথমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। বিকেল নাগাদ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে পল্টন, বিজয়নগর, মতিঝিলসহ আশপাশের এলাকায়।
মৃত্যুর মিছিল ও ভয়াবহতা
নৃশংস এই সংঘর্ষে প্রাণ হারান অন্তত ১২ জন। নিহতদের মধ্যে ৯ জন ছিলেন জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী। টেলিভিশনের ফুটেজে দেখা যায় লগি-বৈঠা দিয়ে পেটানো, রক্তাক্ত লাশ টেনে নেওয়া এবং লাশের ওপর নাচের দৃশ্য, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়। এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সেদিন মানুষ মানুষকে এমনভাবে পেটাচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল রক্তে ঢাকা রাস্তা।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পর আওয়ামী লীগ দাবি করে, তারা আত্মরক্ষার্থে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। অপরদিকে, জামায়াতে ইসলামী ও চারদলীয় জোট একে ‘পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ’ বলে আখ্যা দেয়। দুই পক্ষের দোষারোপের রাজনীতির মধ্যেই দাফন, প্রতিবাদ ও পাল্টা কর্মসূচির জেরে দেশজুড়ে উত্তেজনা আরও বাড়ে।
প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাই এই সহিংসতাকে ভয়াবহ করে তোলে। পুলিশ পর্যাপ্ত সংখ্যায় উপস্থিত ছিল না, যারা ছিল তারাও প্রাথমিকভাবে নিষ্ক্রিয় ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটলে পরবর্তীতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি ওঠে।
দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
পল্টনের এই ঘটনার পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সমঝোতা ব্যর্থ হলে অবশেষে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। একটি সামরিক-সহায়ক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। যা পরবর্তীতে ফ্যাসিস্ট সরকারের জন্ম দেয়।
রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা একমত যে, ২৮ অক্টোবর ২০০৬ কেবল একটি সহিংস দিনের স্মৃতি নয়; এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশপথে এক বড় শিক্ষা। রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা ও দায়িত্ববোধের অভাবে কীভাবে একটি জাতি অরাজকতার মুখে পড়তে পারে সেদিনের ঘটনা তারই জ্বলন্ত উদাহরণ।
দুই দশক পার হয়ে গেলেও ভয়াল ২৮ অক্টোবরের স্মৃতি আজও তাজা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ধ্বংস নয়, সংলাপ ও সহনশীলতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করাই হতে পারে সেই দিনের ভয়াবহতার একমাত্র ইতিবাচক শিক্ষা।





