সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি :
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার চিলাই নদীসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলনের প্রতিবাদে রবিবার (২৬ অক্টোবর) সকালে উপজেলা পরিষদের সামনে এক বিশাল মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ কর্মসূচির আয়োজন করে হাওর ও নদী রক্ষা আন্দোলন, দোয়ারাবাজার উপজেলা শাখা।
মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা আহ্বায়ক নুরুল ইসলাম, এবং সঞ্চালনা করেন উপজেলা সদস্য সচিব মুফতি আবু তাহের মিসবাহ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন হাওর ও নদী রক্ষা আন্দোলন সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রাজু আহমেদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন জাতীয় মানবাধিকার সোসাইটি সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা সভাপতি, সাবেক সেনা সদস্য আব্দুল আওয়াল।
এছাড়াও বক্তব্য রাখেন উপজেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সভাপতি এশার মিয়া, উপজেলা যুগ্ম আহ্বায়ক হুসাইন মুহাম্মদ এমরাজ, কাজী ইউসুফ, উপজেলা সদস্য মোফাজ্জল হাসান, মান্নারগাঁও ইউনিয়নের আহ্বায়ক মাওলানা আব্দুর রউফ, লক্ষীপুর ইউনিয়নের যুগ্ম আহ্বায়ক ইব্রাহিম খলিল, বাংলাবাজার ইউনিয়নের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর হোসেন, এবং সুরমা ইউনিয়নের আহ্বায়ক মাওলানা বদিউজ্জামান মুরাদ প্রমুখ।
বক্তারা অভিযোগ করেন, চিলাই নদীসহ উপজেলার বিভিন্ন নদীতে প্রতিনিয়ত রাতের আঁধারে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে, অথচ প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করছে। তারা বলেন “যখনই জনগণ প্রতিবাদ করে, তখন দু’একটি নৌকা আটকিয়ে প্রশাসন ‘অভিযান দেখানোর নাটক’ মঞ্চস্থ করে। অথচ মূল হোতারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।”
তারা আরও বলেন, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও কিছু প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়ায় এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এর ফলে চিলাই, মৌলা ও খাসিয়ামারা নদীর তীর ভাঙছে, কৃষকের ফসলি জমি ধ্বংস হচ্ছে, সেতু-কালভার্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
বক্তারা আরও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “থানার সামনেই নৌকা ভর্তি বালু উঠানো হচ্ছে, কিন্তু প্রশাসন নীরব দর্শক। এ যেন জনগণের সঙ্গে প্রতারণা।” তারা অভিযোগ করেন, ড্রেজার ও এক্সকাভেটর দিয়ে প্রকাশ্যে নদী খনন চলছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি ও পরিবেশবিধি পরিপন্থী।
কেউ কেউ বলেন, প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার ‘নীরব অনুমোদন’ ছাড়া এত বড় অবৈধ কর্মকাণ্ড সম্ভব নয়।
বক্তারা প্রশাসনের ব্যর্থতার কড়া সমালোচনা করে আরও বলেন, “কেউ কেউ দায়িত্ব পালনের নামে শুধু মিটিং-মাইক্রোফোনে সীমাবদ্ধ থাকেন। কিন্তু মাঠে বাস্তব কোনো অভিযান দেখা যায় না। প্রশাসনের নীরবতা এখন জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ।” তারা আরও জানান, প্রভাবশালী সিন্ডিকেট এসব অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করছে, আর এর ফলে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
মানববন্ধনে বক্তারা চিলাই নদীসহ দোয়ারাবাজার উপজেলার যেসব ইজারা বহির্ভূত অবৈধ বালু মহাল রয়েছে, সেগুলো অবিলম্বে বন্ধের জন্য প্রশাসনের প্রতি সবিনয়ে আহ্বান জানান।
তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন — “অন্যথায় হাওর ও নদী রক্ষা আন্দোলন দোয়ারাবাজার উপজেলা শাখার পক্ষ থেকে প্রশাসনের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে। সেই আন্দোলন শামাল দেওয়া কাউর পক্ষেই সম্ভব হবে না।”
বক্তারা আরও জানান, যদি প্রশাসন দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে নদীর পাড়ে অবস্থান কর্মসূচি, সড়ক অবরোধসহ বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে। তারা প্রশাসনকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “নদী ধ্বংস হওয়া মানেই জনগণের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হওয়া; এখন সময় এসেছে সত্যিকারের দেশপ্রেমের পরীক্ষা দেওয়ার।”
এসময় উপজেলা প্রশাসনের নিকট হাওর ও নদী রক্ষা আন্দোলনের ১৫ দফা দাবি পেশ করা হয়:
১️. দোয়ারাবাজারের সব অবৈধ বালু-পাথর উত্তোলন অবিলম্বে বন্ধে বিশেষ অভিযান।
২️. চিলাই, মৌলা ও খাসিয়ামারা নদীতে নিয়মিত টহল ও মনিটরিং।
৩️. প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা।
৪️. বালুবাহী ট্রাক ও ট্রাক্টরের অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রণে চেকপোস্ট স্থাপন।
৫️. ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও নদীপাড়ের পরিবারদের ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা।
৬️. নদী তীরবর্তী অবকাঠামো, সেতু ও কালভার্ট সংস্কার।
৭️.ড্রেজার ও এক্সকাভেটর ব্যবহারে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা।
৮️. শিক্ষার্থীদের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে খেয়াঘাটে নির্দিষ্ট সময় বালু পরিবহন বন্ধ।
৯️.নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ও জব্দকৃত মালামাল নিলাম।
১০️.নদী সংরক্ষণে জনসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালু।
১১️.শিল্প ও গৃহস্থালি বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধে কঠোর নজরদারি।
১২️. নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে সরকারি খনন ও সংরক্ষণ কার্যক্রম।
১৩️. হাওর এলাকায় পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ।
১৪️.আইন প্রয়োগে ব্যর্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ।
১৫️. হাওর ও নদী রক্ষা আন্দোলনের অভিযোগ ও প্রস্তাব গুরুত্বসহ বিবেচনা।
এসময় বক্তারা এক কণ্ঠে বলেন —
“আমরা প্রশাসনের শত্রু নই, বরং তাদের সহযোগী হতে চাই। কিন্তু যদি তারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় নামবো। নদী বাঁচাতে প্রয়োজনে জীবন দিতে প্রস্তুত আছি।”
মানববন্ধনে আরও উপস্থিত ছিলেন উপজেলা কমিটির সদস্য আলমগীর হোসেন, মান্নারগাঁও ইউনিয়নের সদস্য সচিব মাওলানা আলমগীর হোসেন, বাংলাবাজার ইউনিয়নের সদস্য সচিব আল আমিন, সদস্য ফজলুর রহমান, সুরমা ইউনিয়নের যুগ্ম আহ্বায়ক মাওলানা বশির আহমেদ ও মুফতি মতিউর রহমান, সদস্য সচিব সালমান হোসেন, এবং বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রতিনিধিসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ।





